হিংসা ও বিদ্বেষ : মানবতার হত্যাকারী:


হিংসা ও বিদ্বেষ : মানবতার হত্যাকারী -মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব ﻋَﻦْ ﺃَﻧَﺲِ ﺑْﻦِ ﻣَﺎﻟِﻚٍ ﺃَﻥَّ ﺭَﺳُﻮْﻝَ ﺍﻟﻠﻪِ ﺻﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻋﻠﻴﻪ ﻭﺳﻠﻢ ﻗَﺎﻝَ : ﻻَ ﺗَﺒَﺎﻏَﻀُﻮْﺍ ﻭَﻻَ ﺗَﺤَﺎﺳَﺪُﻭْﺍ ﻭَﻻَ ﺗَﺪَﺍﺑَﺮُﻭْﺍ ﻭَﻻَ ﺗَﻘَﺎﻃَﻌُﻮْﺍ ﻭَﻛُﻮْﻧُﻮْﺍ ﻋِﺒَﺎﺩَ ﺍﻟﻠﻪِ ﺇِﺧْﻮَﺍﻧًﺎ، ﺭﻭﺍﻩ ﺍﻟﺒﺨﺎﺭﻱ – অনুবাদ : হযরত আনাস বিন মালেক (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, তোমরা পরস্পরে বিদ্বেষ করো না, হিংসা করো না, ষড়যন্ত্র করো না ও সম্পর্ক ছিন্ন করো না। তোমরা পরস্পরে আল্লাহর বান্দা হিসাবে ভাই ভাই হয়ে যাও’।[1] ব্যাখ্যা : অত্র হাদীছে মানবতাকে হত্যাকারী কয়েকটি দুরারোগ্য ব্যাধির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা ইসলামী সমাজকে ভিতর থেকে ধ্বংস করে দেয়। এখানে চারটি বিষয় উল্লেখ করা হলেও তা মূলতঃ একটি থেকে উৎসারিত। আর তা হ’ল ‘হিংসা’। এই মূল বিষবৃক্ষ থেকেই বাকীগুলি কাঁটাযুক্ত ও যন্ত্রণাদায়ক ডাল-পালার ন্যায় বেরিয়ে আসে। হিংসা অর্থ ﺃﻥْ ﻳَﺤْﺴُﺪَ ﻋَﻠﻰَ ﻣﺎ ﺃﻧﻌَﻢَ ﺍﻟﻠﻪُ ﻋﻠﻴﻪ ﺑﻪ، ﻭﺃﻥ ﻳﺘﻤﻨﻲ ﺯَﻭَﺍﻝَ ﻧِﻌْﻤَﺘِﻪِ ‘আল্লাহ অন্যকে যে নে‘মত দান করেছেন তাকে হিংসা করা এবং উক্ত নে‘মতের ধ্বংস কামনা করা’। আর হিংসুক হ’ল, ﺍﻟﺤﺮﻳﺺ ﻋﻠﻲ ﺯﻭﺍﻝِ ﺍﻟﻨِّﻌْﻤَﺔِ ﻋﻠﻲ ﺍﻟْﻤَﺤْﺴُﻮﺩ ‘হিংসাকৃত ব্যক্তির নে‘মত ধ্বংসের আকাংখী’। হিংসার পিছে পিছে আসে বিদ্বেষ। সে তখন সর্বদা ঐ ব্যক্তির মন্দ কামনা করে। যেমন মুমিনদের বিরুদ্ধে মুনাফিকদের আচরণ সম্পর্কে আল্লাহ বলেন, ﺇِﻥْ ﺗَﻤْﺴَﺴْﻜُﻢْ ﺣَﺴَﻨَﺔٌ ﺗَﺴُﺆْﻫُﻢْ ﻭَﺇِﻥْ ﺗُﺼِﺒْﻜُﻢْ ﺳَﻴِّﺌَﺔٌ ﻳَﻔْﺮَﺣُﻮْﺍ ﺑِﻬَﺎ‘যদি তোমাদের কোন কল্যাণ স্পর্শ করে, তাতে তারা অসন্তুষ্ট হয়। আর যদি তোমাদের কোন অকল্যাণ হয়, তাতে তারা আনন্দিত হয়’ (আলে ইমরান ৩/১২০) । বস্ত্ততঃ এ দু’টি বদস্বভাবের মধ্যে ঈমানের কোন অংশ নেই। কেননা মুমিন সর্বদা অন্যের শুভ কামনা করে। যেমন সে সর্বদা নিজের শুভ কামনা করে। রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেন, ﻻ ﻳُﺆْﻣِﻦُ ﺃَﺣَﺪُﻛُﻢْ ﺣَﺘَّﻰ ﻳُﺤِﺐَّ ﻷَﺧِﻴْﻪِ ﻣَﺎ ﻳُﺤِﺐُّ ﻟِﻨَﻔْﺴِﻪِ ‘তোমাদের কেউ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য ঐ বস্ত্ত ভালবাসবে, যা সে নিজের জন্য ভালবাসে’।[2] যে ব্যক্তি মানুষের প্রতি হিংসা ও বিদ্বেষ পোষণ করে, তার ঈমান হয় ত্রুটিপূর্ণ। হিংসা তার সমস্ত নেকীকে খেয়ে ফেলে যেমন আগুন ধীরে ধীরে কাঠকে খেয়ে ফেলে। এভাবে সে নিজের আগুনে নিজে জ্বলে মরে। পরিণামে তার পূর্বে কৃত সৎকর্ম সমূহের নেকীগুলিও ক্রমে নিঃশেষ হয়ে যায়। ঐ অবস্থায় তার মৃত্যু হ’লে সে নিঃস্ব অবস্থায় আল্লাহর কাছে চলে যায়। অতএব একজন মুসলিমের কর্তব্য হ’ল সর্বদা সাদা মনের অধিকারী থাকা। তার অন্তরে যেন কারু প্রতি হিংসার কালিমা না থাকে। যদি কোন কারণ বশতঃ সেটা কখনো এসেই যায়, তবে বুদ্বুদের মত যেন তা উবে যায়। কচুর পাতার পানির মত যেন তা ঝরে যায়। হৃদয় যেন সকলের প্রতি উদার থাকে এবং শত্রু-মিত্র সকলের প্রতি হেদায়াতের আকাংখী থাকে। এমন অবস্থায় নিদ্রা যাবে, যেন তার হৃদয়ের কোণে কারু প্রতি হিংসার কালো মেঘ জমে না থাকে। কেননা এই নিদ্রা তার চিরনিদ্রা হ’তে পারে। ভালোবাসা ও বিদ্বেষের মানদন্ড হবে কেবল ঈমান। আল্লাহর জন্য ভালোবাসা ও আল্লাহর জন্য বিদ্বেষ এটিই হল মানদন্ড। কোন মুমিন কোন কাফিরকে কখনোই উদারভাবে ভালবাসতে পারে না। কেননা কাফিরের মধ্যে কোন কল্যাণ নেই। তাকে ভালোবাসার মধ্যে আখেরাতে কিছুই পাবার নেই। এক্ষেত্রে কাফিরকে তার কুফর থেকে ঈমানের দিকে ফিরানোর সাধ্যমত চেষ্টা করাই হবে তার প্রতি ভালবাসার সঠিক নমুনা। এটা না করলে মুমিন গোনাহগার হবে ও আল্লাহর নিকট কৈফিয়তের সম্মুখীন হবে। কেননা মুমিন ও কাফির উভয়ে একই পিতা আদমের সন্তান। আদম (আঃ) মুসলিম ছিলেন। তাই উভয়ে বংশসূত্রে মুসলিম। কিন্তু না বুঝে অথবা বাপ-দাদার দোহাই দিয়ে যদি কেউ কাফির-মুশরিক হয়ে থাকে, তবে তাকে বুঝিয়ে আল্লাহর পথে ফিরিয়ে আনা মুমিনের অবশ্য কর্তব্য। যেসব মুসলিমের পিতা-মাতা কাফির বা মুশরিক অবস্থায় মারা গেছেন, তারা সর্বদা জাহান্নামের আগুনে জ্বলছেন, এ দৃশ্য চিন্তা করে কোন মুসলিম সন্তান স্থির থাকতে পারেন কি? একইভাবে মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও যারা শিরক ও বিদ‘আতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেছে, তাদের পরিণামও জাহান্নাম। তাদের নিকটাত্মীয়রা কি তাদের জীবন্ত আগুনে পোড়ার জ্বলন্ত দৃশ্য মনের আয়নায় দেখে সহ্য করতে পারবেন? তাই কাফির-মুশরিক, মুনাফিক ও ফাসিকদের প্রতি বিদ্বেষ-এর অর্থ হ’ল তাদের অবিশ্বাস ও অপকর্মকে ঘৃণা করা ও নিজেকে তা থেকে বাঁচিয়ে রাখা। তবে সকল আদম সন্তানের হেদায়াতের জন্য নিজের হৃদয়কে সদা উন্মুক্ত ও বিদ্বেষ মুক্ত রাখাটাই হ’ল প্রকৃত মুমিনের নিদর্শন। হিংসা ও বিদ্বেষ হ’ল অন্তরের বিষয়। কিন্তু তার বিষফল হিসাবে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ও সম্পর্কচ্ছেদ ইত্যাদি হ’ল কর্মের বিষয়। তাই অন্তর বিদ্বেষমুক্ত না হ’লে কর্ম অন্যায়মুক্ত হয় না। যদি কোন মুমিন পাপকর্ম করে, তাহ’লে তার পাপকে ঘৃণা করবে। কিন্তু ঈমানের কারণে তাকে ভালবাসবে। কেননা আল্লাহ বলেছেন, ﺇِﻧَّﻤَﺎ ﺍﻟْﻤُﺆْﻣِﻨُﻮْﻥَ ﺇِﺧْﻮَﺓٌ ‘নিশ্চয়ই মুমিনগণ সকলে ভাই ভাই’ (হুজুরাত ৪৯/১০)। আর ভাইয়ের প্রতি সত্যিকারের ভালোবাসা তখনই বুঝা যাবে, যখন তার পাপের কারণে তাকে ঘৃণা করা হবে। তাতে সে তওবা করে ফিরে আসতে পারে। নইলে পাপী হওয়া সত্ত্বেও তাকে ভালবাসলে সে কখনোই তওবা করবে না এবং পাপ ও পুণ্যে কোন ভেদাভেদ থাকবে না। বরং প্রকৃত ঈমানের নিদর্শন হ’ল ফাসেক-মুনাফিকদের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা এবং সত্যের পক্ষে সমর্থন ও মিথ্যার বিপক্ষে ক্রোধ প্রকাশ করা। যেমন হযরত আবু উমামা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ﻣَﻦْ ﺃَﺣَﺐَّ ﻟِﻠَّﻪِ ﻭَﺃَﺑْﻐَﺾَ ﻟِﻠَّﻪِ ﻭَﺃَﻋْﻄَﻰ ﻟِﻠَّﻪِ ﻭَﻣَﻨَﻊَ ﻟِﻠَّﻪِ ﻓَﻘَﺪِ ﺍﺳْﺘَﻜْﻤَﻞَ ﺍﻹِﻳْﻤَﺎﻥَ ‘যে আল্লাহর জন্য অপরকে ভালবাসে ও আল্লাহর জন্য বিদ্বেষ করে, আল্লাহর জন্য দান করে ও আল্লাহর জন্য বিরত থাকে, সে তার ঈমানকে পূর্ণ করল’।[3] একবার রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-কে জিজ্ঞেস করা হ’ল শ্রেষ্ঠ মানুষ কে? তিনি বললেন, ﻛُﻞُّ ﻣَﺨْﻤُﻮْﻡِ ﺍﻟْﻘَﻠْﺐِ ﺻَﺪُﻭْﻕِ ﺍﻟﻠِّﺴَﺎﻥِ ‘প্রত্যেক শুদ্ধহৃদয় ও সত্যভাষী ব্যক্তি’। লোকেরা বলল, সত্যভাষীকে আমরা চিনতে পারি। কিন্তু শুদ্ধহৃদয় ব্যক্তিকে আমরা কিভাবে চিনব? জবাবে তিনি বললেন, ﻫُﻮَ ﺍﻟﺘَّﻘِﻰُّ ﺍﻟﻨَّﻘِﻰُّ ﻻَ ﺇِﺛْﻢَ ﻓِﻴْﻪِ ﻭَﻻَ ﺑَﻐْﻰَ ﻭَﻻَ ﻏِﻞَّ ﻭَﻻَ ﺣَﺴَﺪَ ‘সে হবে আল্লাহভীরু ও পরিচ্ছন্ন হৃদয়; যাতে কোন পাপ নেই, সত্যবিমুখতা নেই, বিদ্বেষ নেই, হিংসা নেই’।[4] হিংসুক থেকে বাঁচার পথ : (১) ক্ষমতা থাকলে প্রতিরোধ করা। যেমন রাসূল (ছাঃ) মদীনার ইহুদী গোত্রগুলির বিরুদ্ধে করেছিলেন এবং অবশেষে তাদেরকে মদীনা থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। (২) সত্য প্রকাশ করে দেওয়া এবং হিংসুক ব্যক্তি বা দলকে এড়িয়ে চলা ও তাদের শাস্তির বিষয়টি আল্লাহর উপর ন্যস্ত করা। যেমন আল্লাহ হিংসুক ইহুদী সম্পর্কে বলেন, ﻓَﺎﻋْﻔُﻮْﺍ ﻭَﺍﺻْﻔَﺤُﻮْﺍ ﺣَﺘَّﻰ ﻳَﺄْﺗِﻲَ ﺍﻟﻠﻪُ ﺑِﺄَﻣْﺮِﻩِ ﺇِﻥَّ ﺍﻟﻠﻪَ ﻋَﻠَﻰ ﻛُﻞِّ ﺷَﻲْﺀٍ ﻗَﺪِﻳْﺮٌ – ‘তোমরা তাদের ক্ষমা কর ও উপেক্ষা করে চলো যতক্ষণ না আল্লাহ স্বীয় আদেশ নিয়ে আগমন করেন। নিশ্চয় আল্লাহ সকল বিষয়ে ক্ষমতাবান’ (বাক্বারাহ ২/১০৯) । হিংসা মুক্ত সমাজ গঠনের জন্য এটাই উত্তম। কেননা হিংসা কেবল হিংসা আনয়ন করে। ভাল-র প্রতি হিংসা : মানুষ অনেক সময় ভাল-র প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করে থাকে। যেমন নবী-রাসূলগণের প্রতি, কুরআন ও হাদীছের প্রতি, ইসলামের প্রতি, সমাজের সত্যসেবী দ্বীনদারগণের প্রতি এবং বিশেষ করে সমাজ সংস্কারক মুত্তাক্বী আলেমগণের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করা পাপাচারী মানুষের স্বভাবগত বিষয়। যেমন (ক) সৃষ্টির সূচনায় প্রথম পাপ ছিল আদম (আঃ)-এর প্রতি ইবলীসের হিংসার পাপ। আদমের উচ্চ সম্মান দেখে সে হিংসায় জ্বলে উঠেছিল। তাকে আদমের প্রতি সম্মানের সিজদা করতে বলা হলে সে করেনি। বরং যুক্তি দেখিয়ে বলেছিল আমি আগুনের তৈরী ও সে হ’ল মাটির তৈরী। অতএব আগুন কখনো মাটিকে সিজদা করতে পারে না। এ যুক্তি দেখিয়ে সে আল্লাহর হুকুম মানতে অস্বীকার করে ও অহংকার করে। ফলে সে জান্নাত থেকে চিরকালের মত বিতাড়িত হয়। অনুরূপভাবে (খ) আদম-পুত্র কাবীল তার ভাই হাবীলকে হত্যা করে হিংসা বশে। কারণ হাবীল ছিল মুত্তাকী পরহেযগার ও শুদ্ধ হৃদয়ের মানুষ। সে আল্লাহকে ভালবেসে তার সর্বোত্তম দুম্বাটি আল্লাহর ওয়াস্তে কুরবানীর জন্য পেশ করে। অথচ তার কৃষিজীবী ভাই ক্বাবীল তার ক্ষেতের সবচেয়ে খারাব ফসলের একটা অংশ কুরবানীর জন্য পেশ করে। ফলে আল্লাহ তারটা কবুল না করে হাবীলের কুরবানী কবুল করেন এবং আসমান থেকে আগুন এসে তা উঠিয়ে নিয়ে যায়। এতে ক্বাবীল হিংসায় জ্বলে ওঠে ও হাবীলকে হত্যা করে। পরবর্তীকালে (গ) ইহুদীরা মুসলমানদের হিংসা করে তাদের নিকট শেষনবী (ছাঃ)-এর আগমনের কারণে। কেননা ইহুদীরা ভেবেছিল শেষনবীর আগমন হবে তাদের মধ্য থেকে। কিন্তু সেটা না হওয়ায় তারা ক্ষেপেছিল। যেমন আল্লাহ বলেন, ﻭَﺩَّ ﻛَﺜِﻴْﺮٌ ﻣِﻦْ ﺃَﻫْﻞِ ﺍﻟْﻜِﺘَﺎﺏِ ﻟَﻮْ ﻳَﺮُﺩُّﻭْﻧَﻜُﻢْ ﻣِﻦْ ﺑَﻌْﺪِ ﺇِﻳﻤَﺎﻧِﻜُﻢْ ﻛُﻔَّﺎﺭًﺍ ﺣَﺴَﺪًﺍ ﻣِﻦْ ﻋِﻨْﺪِ ﺃَﻧْﻔُﺴِﻬِﻢْ ﻣِﻦْ ﺑَﻌْﺪِ ﻣَﺎ ﺗَﺒَﻴَّﻦَ ﻟَﻬُﻢُ ﺍﻟْﺤَﻖُّ ‘আহলে কিতাবগণের মধ্যে বহু লোক চায় তোমাদেরকে ঈমান আনার পরে কুফরীতে ফিরিয়ে নিতে তাদের নিকট সত্য প্রকাশিত হওয়ার পরে স্রেফ বিদ্বেষবশতঃ’ (বাক্বারাহ ২/১০৯)। ওদিকে আবু জাহল শেষনবী (ঘ) মুহাম্মাদ (ছাঃ)-কে সত্য বলে স্বীকার করেও মেনে নেয়নি তার বনু মখযূম গোত্রে জন্ম না হয়ে বনু হাশেম গোত্রে জন্ম হওয়ার কারণে। এভাবে ভাল-র প্রতি হিংসার ইতিহাস চিরন্তন। ঐসব হিংসুকরা নিজেদের হিংসা গোপন করার জন্য ভাল-র বিরুদ্ধে নানাবিধ মিথ্যা রটনা করে। তাকে নানাবিধ কষ্ট দেয়, এমনকি দেশ ত্যাগে বাধ্য করে ও হত্যার চেষ্টা করে। যেমন শেষনবী (ছাঃ)-এর বিরুদ্ধে তাঁর বিরোধীরা করেছিল। অথচ তিনি এজন্য আদৌ দায়ী ছিলেন না। যদিও প্রবাদ আছে যে, ‘এক হাতে তালি বাজে না’। অথচ নবী- রাসূলগণ ও তাঁদের নিখাদ অনুসারী নেককার মুমিনদের বিরুদ্ধে যাবতীয় ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত এক পক্ষীয় হয়ে থাকে। সকল যুগে এর অসংখ্য নযীর রয়েছে। বর্তমান যুগেও এমন নযীরের কোন অভাব নেই। সেকারণ হিংসুকদের অনিষ্টকারিতা হ’তে বাঁচার জন্য আল্লাহ আমাদের প্রার্থনা করতে বলেছেন- ﻭَﻣِﻦْ ﺷَﺮِّ ﺣَﺎﺳِﺪٍ ﺇِﺫَﺍ ﺣَﺴَﺪَ ‘হে আল্লাহ! আমি তোমার নিকট আশ্রয় চাই হিংসুকের অনিষ্টকারিতা হতে যখন সে হিংসা করে’ (ফালাক্ব ১১৩/৫)। যে সমাজে হিংসার প্রসার যত বেশী, সে সমাজে অশান্তি তত বেশী। সমাজে অতক্ষণ যাবত কল্যাণ ও শান্তি বিরাজ করে, যতক্ষণ সেখানে হিংসার প্রসার না ঘটে। যামরাহ বিন ছা‘লাবাহ (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ﻻَ ﻳَﺰَﺍﻝُ ﺍﻟﻨَّﺎﺱُ ﺑِﺨَﻴْﺮٍ ﻣَﺎ ﻟَﻢْ ﻳَﺘَﺤَﺎﺳَﺪُﻭْﺍ‘মানুষ অতক্ষণ কল্যাণের মধ্যে থাকবে, যতক্ষণ তারা পরস্পরে হিংসা না করবে’। [5] হিংসার পরিণাম : হিংসুক ব্যক্তি অন্যকে ক্ষতি করার আগে সে নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কেননা শুরুতেই সে হিংসার আগুনে জ্বলতে থাকে। হিংসা দূর না হওয়া পর্যন্ত এটাই তার জন্য স্থায়ী দুনিয়াবী শাস্তি। তার চেহারা সর্বদা মলিন থাকে। তার সাথে তার পরিবারে হাসি ও আনন্দ থাকে না। অন্যের ক্ষতি করার চক্রান্তে ও ষড়যন্ত্রে সে সর্বদা ব্যস্ত থাকে। প্রতিপক্ষের হামলার ভয়ে সে সর্বদা ত্রস্ত ও ভীত থাকে। নিশুতি রাতে বাঁশ ঝাড়ে কঞ্চির শব্দে জিনের ভয়ে হার্টফেল করার মত হিংসুক ব্যক্তি সর্বদা কল্পিত শত্রুর ভয়ে শংকিত থাকে। তার অন্তর সদা সংকুচিত থাকে। তারই মত শঠেরা তার বন্ধু হয়। ফলে সৎ সংসর্গ থেকে সে বঞ্চিত হয়। ঘুণ পোকা যেমন কাঁচা বাঁশকে ভিতর থেকে কুরে কুরে খায়, হিংসুক ব্যক্তির অন্তর তেমনি হিংসার আগুন কুরে কুরে খায়। এক সময় সে ধ্বংস হয়ে যায়, যেমন ঘুণে ধরা বাঁশ হঠাৎ ভেঙ্গে পড়ে যায়। এভাবে দুনিয়ায় সে এসি ঘরে শুয়ে থেকে হিংসার আগুনে জ্বলে- পুড়ে মরে। আর মৃত্যুর পরে তাকে গ্রাস করে জাহান্নামের ভয়াবহ আগুন। দুনিয়ায় সে যেমন ছিল সর্বদা মলিন চেহারার অসুখী মানুষ, আখেরাতেও সে উঠবে তেমনি মলিন চেহারায় অধোমুখি হয়ে। আল্লাহ বলেন, ﻭَﻭُﺟُﻮْﻩٌ ﻳَﻮْﻣَﺌِﺬٍ ﻋَﻠَﻴْﻬَﺎ ﻏَﺒَﺮَﺓٌ – ﺗَﺮْﻫَﻘُﻬَﺎ ﻗَﺘَﺮَﺓٌ – ﺃُﻭْﻟَﺌِﻚَ ﻫُﻢُ ﺍﻟْﻜَﻔَﺮَﺓُ ﺍﻟْﻔَﺠَﺮَﺓُ ‘অনেক মুখমন্ডল সেদিন হবে ধূলি ধূসরিত’ ‘কালিমালিপ্ত’ তারা হ’ল অবিশ্বাসী পাপিষ্ঠ’ (‘আবাসা ৮০/৪০-৪২)। তাদেরকে দেখে যেমন দুনিয়াতে চেনা যেত। আখেরাতেও তেমনি চেনা যাবে। যেমন আল্লাহ বলেন, ﻳُﻌْﺮَﻑُ ﺍﻟْﻤُﺠْﺮِﻣُﻮْﻥَ ﺑِﺴِﻴﻤَﺎﻫُﻢْ ﻓَﻴُﺆْﺧَﺬُ ﺑِﺎﻟﻨَّﻮَﺍﺻِﻲْ ﻭَﺍﻟْﺄَﻗْﺪَﺍﻡِ ‘অপরাধীদের চেনা যাবে তাদের চেহারা দেখে। অতঃপর তাদেরকে পাকড়াও করা হবে কপালের চুল ও পা ধরে’ (রহমান ৫৫/৪১)। হযরত যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ﺩَﺏَّ ﺇِﻟَﻴْﻜُﻢْ ﺩَﺍﺀُ ﺍﻷُﻣَﻢِ ﻗَﺒْﻠَﻜُﻢُ ﺍﻟْﺤَﺴَﺪُ ﻭَﺍﻟْﺒَﻐْﻀَﺎﺀُ ﻫِﻰَ ﺍﻟْﺤَﺎﻟِﻘَﺔُ ‘তোমাদের মধ্যে পিপীলিকার ন্যায় প্রবেশ করবে বিগত উম্মতগণের রোগ। আর তা হ’ল হিংসা ও বিদ্বেষ। যা হ’ল ছাফকারী। ﻻَ ﺃَﻗُﻮْﻝُ ﺗَﺤْﻠِﻖُ ﺍﻟﺸَّﻌْﺮَ ﻭَﻟَﻜِﻦْ ﺗَﺤْﻠِﻖُ ﺍﻟﺪِّﻳْﻦَ ‘আমি বলিনা যে চুল ছাফ করবে, বরং তা দ্বীনকে ছাফ করে ফেলবে’। [6] অর্থাৎ ক্ষুর ও ব্লেড যেমন চুল ছাফ করে দেয়। হিংসা ও বিদ্বেষ তেমনি দ্বীনকে বিদূরিত করে দেয়। ইসলামের সোনালী যুগে মুসলমানদের উন্নতি ও বিশ্ব বিজয়ের মূলে কারণ ছিল তাদের পারস্পরিক মহববত-ভালোবাসা ও বিদ্বেষমুক্ত হৃদয়ের সৃদৃঢ় বন্ধন। তারা অন্যের দুঃখ- বেদনাকে নিজের সাথে ভাগ করে নিতেন। তারা অন্যের জন্য সেটাকেই ভালবাসতেন, যেটা নিজের জন্যে ভালবাসতেন। এ বিষয়ে মক্কার মুহাজির মুসলমানদের জন্য মদীনার আনছারগণের অনন্য ত্যাগের দৃষ্টান্ত বিশ্ব ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। এমনকি যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুপথ যাত্রী মুসলিম সৈনিক তৃষ্ণার্ত পানিপ্রার্থী অন্য সৈনিকের স্বার্থে নিজে পানি পান না করেই প্রাণত্যাগ করে মৃত্যুর দুয়ারে মানবতার চরম পরাকাষ্ঠা দেখিয়ে গেছেন। ইতিহাসে এর কোন তুলনা নেই। হযরত আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) বলেন, আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট বসে আছি। এমন সময় তিনি বললেন, ﻳَﻄْﻠُﻊُ ﻋَﻠَﻴْﻜُﻢُ ﺍﻵﻥَ ﺭَﺟُﻞٌ ﻣِﻦْ ﺃَﻫْﻞِ ﺍﻟْﺠَﻨَّﺔِ ‘এখন তোমাদের নিকট একজন জান্নাতী মানুষের আগমন ঘটবে’। অতঃপর আনছারদের একজন ব্যক্তি আগমন করল। যার দাড়ি দিয়ে ওযুর পানি টপকাচ্ছিল ও তার বামহাতে জুতা জোড়া ছিল। দ্বিতীয় দিন ও তৃতীয় দিন রাসূল (ছাঃ) একই রূপ বললেন এবং পরক্ষণে একই ব্যক্তির আগমন ঘটলো। অতঃপর যখন রাসূল (ছাঃ) মজলিস থেকে উঠলেন, তখন আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল ‘আছ তাঁর পিছু নিলেন। …আনাস (রাঃ) বলেন, আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাঃ) বলেন যে, আমি তার বাসায় একরাত বা তিন রাত কাটাই। কিন্তু তাকে রাতে ছালাতের জন্য উঠতে দেখিনি। কেবল ফজরের জন্য ওযূ করা ব্যতীত। তাছাড়া আমি তাকে সর্বদা ভাল কথা বলতে শুনেছি। এভাবে তিনদিন তিনরাত চলে গেলে আমি তার আমলকে সামান্য মনে করতে লাগলাম ‏( ﻛِﺪْﺕُ ﺃَﻥْ ﺃَﺣْﺘَﻘِﺮَ ﻋَﻤَﻠَﻪُ‏) । আমি তখন ঐ ব্যক্তিকে বললাম, আপনার সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) এই এই কথা বলেছিলেন এবং আমিও আপনাকে গত তিনদিন যাবৎ দেখছি। কিন্তু আপনাকে বড় কোন আমল করতে দেখলাম না ‏( ﻓَﻠَﻢْ ﺃَﺭَﻙَ ﺗَﻌْﻤَﻞُ ﻛَﺒِﻴْﺮَ ﻋَﻤَﻞٍ‏) । তাহলে কোন বস্ত্ত আপনাকে ঐ স্থানে পৌঁছিয়েছে, যার সুসংবাদ আল্লাহর রাসূল (ছাঃ) আমাদেরকে শুনিয়েছেন। তিনি বললেন, আমি যা করি তাতো আপনি দেখেছেন। অতঃপর যখন আমি চলে আসার জন্য পিঠ ফিরাই, তখন তিনি আমাকে ডেকে বললেন, ﻣَﺎ ﻫُﻮَ ﺇِﻻَّ ﻣَﺎ ﺭَﺃَﻳْﺖَ ﻏَﻴْﺮَ ﺃَﻧِّﻰْ ﻻَ ﺃَﺟِﺪُ ﻓِﻰْ ﻧَﻔْﺴِﻰْ ﻷَﺣَﺪٍ ﻣِﻦَ ﺍﻟْﻤُﺴْﻠِﻤِﻴْﻦَ ﻏِﻼًّ ﻭَﻻَ ﺃَﺣْﺴُﺪُ ﺃَﺣَﺪﺍً ﻋَﻠَﻰ ﺧَﻴْﺮٍ ﺃَﻋْﻄَﺎﻩُ ﺍﻟﻠﻪُ ﺇِﻳَّﺎﻩُ ‘আপনি যা দেখেছেন, তাতো দেখেছেন। তবে আমি আমার অন্তরে কোন মুসলিমের প্রতি কোনরূপ বিদ্বেষ রাখি না এবং আমি কারু প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত কোন কল্যাণের উপর হিংসা পোষণ করি না’। একথা শুনে আব্দুল্লাহ বিন আমর বললেন, ﻫَﺬِﻩِ ﺍﻟَّﺘِﻰْ ﺑَﻠَﻐَﺖْ ﺑِﻚَ ﻭَﻫِﻰَ ﺍﻟَّﺘِﻰْ ﻻَ ﻧُﻄِﻴْﻖُ ‘এটিই আপনাকে উক্ত স্তরে পৌঁছেছে। এটি এমন এক বস্ত্ত যা আমরা করতে সক্ষম নই।[7] হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ﻻَ ﻳَﺠْﺘَﻤِﻌَﺎﻥِ ﻓِﻰْ ﻗَﻠْﺐِ ﻋَﺒْﺪٍ ﺍﻹِﻳْﻤَﺎﻥُ ﻭَﺍﻟْﺤَﺴَﺪُ ‘কোন বান্দার অন্তরে ঈমান ও হিংসা একত্রিত হতে পারে না’।[8] অর্থাৎ একটি অন্তরে হয় ঈমান থাকবে, নয় হিংসা থাকবে। ঈমানদারের অন্তরে হিংসা থাকবে না, হিংসুকের অন্তরে ঈমান থাকবে না। মুমিন কখনো হিংসুক নয়, হিংসুক কখনো মুমিন নয়। অর্থাৎ পূর্ণ মুমিন নয়। হিংসুকদের চটকদার যুক্তি : হিংসুক ব্যক্তি তার চাকচিক্যপূর্ণ কথা ও আকর্ষণীয় যুক্তির মাধ্যমে সত্যকে মিথ্যা বলে ও মিথ্যাকে সত্য বলে। এ বিষয়ে খ্যাতনামা তাবেঈ ইকরিমা বিগত যুগে বনু ইস্রাঈলের একটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন যে, তাদের মধ্যে তিনজন বিখ্যাত কাযী বা বিচারপতি ছিলেন। পরে তাদের একজন মারা গেলেন। তখন অন্যজন তার স্থলাভিষিক্ত হ’লেন। তিনি বিচারকার্য চালাতে থাকলেন। এমন সময় একদিন আল্লাহ একজন ফেরেশতাকে পাঠালেন। যিনি ঘোড়ায় চড়ে একজন ব্যক্তির পাশ দিয়ে যাচ্ছিলেন। যে বাছুরসহ তার গাভীকে পানি পান করাচ্ছিল। ফেরেশতা বাছুরটিকে তার দিকে ডাক দিলেন। তাতে বাছুরটি ঘোড়ার পিছে পিছে চলল। তখন ঐ লোকটি ছুটে এসে তার বাছুরটিকে ফিরিয়ে নিতে চাইল এবং বলল, হে আল্লাহর বান্দা! এটি আমার বাছুর এবং আমার এই গাভীর বাচ্চা। ফেরেশতা বললেন, বরং ওটা আমার বাছুর এবং আমার এই ঘোড়ার বাচ্চা। কেউ দাবী না ছাড়লে অবশেষে তারা একজন কাযীর কাছে গেলেন। বাছুরের মালিক বলল, এই লোকটি আমার বাছুরের পাশ দিয়ে যাবার সময় তাকে ডাকল, আর বাছুরটি তার পিছে পিছে চলে গেল। অথচ বাছুরটি আমার। কিন্তু এখন সে আমাকে ফেরৎ দিচ্ছে না। উত্তরে বিবাদী ফেরেশতা বললেন এমতাবস্থায় যে, তার হাতে তিনটি বেত ছিল। যার অনুরূপ কোন বেত সচরাচর দেখা যায় না। তার মধ্যে একটি বেত তিনি বিচারকের হাতে দিয়ে বললেন, আপনি এটা দিয়ে আমাদের মাঝে ফায়ছালা করুন। বিচারক বললেন, কিভাবে? বিবাদী বললেন, আমরা বাছুরটাকে ঘোড়া ও গাভীর পিছনে ছেড়ে দিব। অতঃপর বাছুরটি যার পিছে পিছে যাবে, সেটি তার হবে। বিচারক সেটাই করলেন। দেখা গেল যে, বাছুরটি ঘোড়ার পিছু নিল। তখন বিচারক বাছুরটি ঘোড়ার বলে রায় দিলেন। বাছুরের মালিক এ রায় মানল না। সে বলল, আমি আরেকজন বিচারকের কাছে যাব। সেখানে গিয়ে উভয়ে পূর্বের মত বাছুরটিকে নিজের বলে দাবী করল এবং আগের মত যুক্তি প্রদর্শন করল। সেখানেও একই রায় হ’ল। তখন বাদী তাতে রাযী না হয়ে তৃতীয় বিচারকের কাছে গেল। বিবাদী তাকে এবার তৃতীয় বেতটি দিলেন। কিন্তু তিনি তা নিতে অস্বীকার করলেন এবং বললেন, আমি আজকে তোমাদের বিচার করব না। তারা বলল, কেন করবেন না? তিনি বললেন, কেননা আমি আজ ঋতুবতী। বিবাদী ফেরেশতা একথা শুনে বলে উঠলেন, সুবহানাল্লাহ! পুরুষ লোক কখনো ঋতুবতী হয়? তখন বিচারক বললেন, ঘোড়া কখনো গরুর বাছুর জন্ম দেয়? অতঃপর তিনি বাছুরটিকে গাভীর মালিককে দিয়ে দিলেন। এবার ফেরেশতা বললেন, আল্লাহ তোমাদের পরীক্ষা করেছেন। তিনি তোমার উপর খুশী হয়েছেন এবং ঐ দুই বিচারকের উপর ক্রুদ্ধ হয়েছেন’।[9] প্রকৃত মুসলিমের পরিচয় : হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ﺍﻟْﻤُﺴْﻠِﻢُ ﺃَﺧُﻮ ﺍﻟْﻤُﺴْﻠِﻢِ ﻻَ ﻳَﻈْﻠِﻤُﻪُ ﻭَﻻَ ﻳَﺨْﺬُﻟُﻪُ ﻭَﻻَ ﻳَﺤْﻘِﺮُﻩُ. ﺍﻟﺘَّﻘْﻮَﻯ ﻫَﺎ ﻫُﻨَﺎ . ﻭَﻳُﺸِﻴْﺮُ ﺇِﻟَﻰ ﺻَﺪْﺭِﻩِ ﺛَﻼَﺙَ ﻣَﺮَّﺍﺕٍ ﺑِﺤَﺴْﺐِ ﺍﻣْﺮِﺉٍ ﻣِﻦَ ﺍﻟﺸَّﺮِّ ﺃَﻥْ ﻳَﺤْﻘِﺮَ ﺃَﺧَﺎﻩُ ﺍﻟْﻤُﺴْﻠِﻢَ ﻛُﻞُّ ﺍﻟْﻤُﺴْﻠِﻢِ ﻋَﻠَﻰ ﺍﻟْﻤُﺴْﻠِﻢِ ﺣَﺮَﺍﻡٌ ﺩَﻣُﻪُ ﻭَﻣَﺎﻟُﻪُ ﻭَﻋِﺮْﺿُﻪُ এক মুসলিম অপর মুসলিমের ভাই। সে তাকে যুলুম করে না, লজ্জিত করে না, নিকৃষ্ট ভাবে না। তাকওয়া এখানে, তাকওয়া এখানে, তাকওয়া এখানে বলে তিনি নিজের বুকের দিকে তিনবার ইশারা করেন। অতঃপর বলেন মানুষের মন্দ হওয়ার জন্য এতটুকু যথেষ্ট যে, সে তার অন্য মুসলিম ভাইকে নিকৃষ্ট ভাবে। মনে রেখ এক মুসলিমের উপর অপর মুসলিমের জন্য হারাম হ’ল তার রক্ত, তার মাল ও তার ইযযত’।[10] হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, ﺇِﻥَّ ﺍﻟﻠﻪَ ﻻَ ﻳَﻨْﻈُﺮُ ﺇِﻟَﻰ ﺻُﻮَﺭِﻛُﻢْ ﻭَﺃَﻣْﻮَﺍﻟِﻜُﻢْ ﻭَﻟَﻜِﻦْ ﻳَﻨْﻈُﺮُ ﺇِﻟَﻰ ﻗُﻠُﻮﺑِﻜُﻢْ ﻭَﺃَﻋْﻤَﺎﻟِﻜُﻢْ ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের চেহারা ও মাল-সম্পদ দেখেন না। বরং তিনি দেখেন তোমাদের অন্তর ও আমল’।[11] হিংসুকের পরিণতি : হিংসুক ও বিদ্বেষী মানুষ কোন অবস্থায় শান্তি পায় না। তার কোন সৎবন্ধু জোটে না। সে কখনোই সুপথপ্রাপ্ত হয় না। তার হৃদয়-মন থাকে সর্বদা জ্বলন্ত অগ্নিকুন্ডের মত। যেখান থেকে সর্বদা চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র, ধোঁকা ও মিথ্যাচারের দুর্গন্ধযুক্ত স্ফুলিঙ্গ সমূহ বের হয়। সে সর্বদা নিজেকে বিজয়ী ভাবে। অথচ সেই-ই সবচেয়ে পরাজিত। সে নিজেকে বীর ভাবে, অথচ সেই-ই সবচেয়ে ভীরু। ভীত-চকিত সর্পের ন্যায় সে তার কল্পিত প্রতিপক্ষকে ছোবল মারার জন্য সর্বদা ফণা উঁচিয়ে থাকে। এভাবে আমৃত্যু সে হিংসার আগুনে জ্বলতে থাকে। ফলে হিংসা-বিদ্বেষ অন্যকে হত্যা করার আগে নিজেকে হত্যা করে। এদিক দিয়ে বিচার করলে হিংসাকেই বড় ন্যায় বিচারক বলতে হয়। কেননা সে সর্বাগ্রে হিংসুককে শাস্তি দেয়, অতঃপর অন্যকে। হিংসুক ব্যক্তি শত চেষ্টায়ও তা গোপন রাখতে পারে না। কেননা শত্রুকে ঘায়েল করার পূর্বে সে নিজেই ঘায়েল হয়। যার নমুনা তার চেহারায় ও কর্মে ফুটে ওঠে। জনৈক কবি বলেন, ﻳﺎ ﺣﺎﺳﺪﺍً ﻟﻲ ﻋﻠﻰ ﻧﻌﻤﺘﻲ + ﺃﺗﺪﺭﻱ ﻋﻠﻰ ﻣﻦ ﺃﺳﺄﺕَ ﺍﻷﺩﺏْ ﺃﺳﺄﺕَ ﻋﻠﻰ ﺍﻟﻠﻪ ﻓﻲ ﻓﻌﻠﻪِ + ﻷﻧﻚَ ﻟﻢ ﺗﺮﺽَ ﻟﻲ ﻣﺎ ﻗﺴﻢْ ﻓﺄﺧﺰﺍﻙَ ﺭﺑﻲ ﺑﺄﻥْ ﺯﺍﺩﻧﻲ + ﻭﺳﺪَّ ﻋﻠﻴﻚَ ﻭﺟﻮﻩَ ﺍﻟﻄﻠﺐْ (১) ‘হে হিংসুক ব্যক্তি! যে আমার নে‘মতে হিংসা করে থাক। তুমি কি জানো তুমি কার সাথে বে-আদবী করো? (২) তুমি আল্লাহর কর্মকে মন্দ বলে থাক। কেননা তিনি আমাকে যা (রহমত) বণ্টন করেছেন তুমি তাতে সন্তুষ্ট নও। (৩) অতএব আমার প্রভু তোমাকে লাঞ্ছিত করুন এ কারণে যে তিনি আমাকে রহমত বেশী দিয়েছেন। আর তোমার উপরে তা বন্ধ করেছেন’। সৎকর্মশীল ঈমানদারগণ কখনো কাউকে হিংসা করেন না। কারু প্রতি বিদ্বেষী হন না। তারা সর্বদা অন্যের হিংসার শিকার হন। তারা আসামী হন, কিন্তু সহজে বাদী হন না। যুগে যুগে এটাই ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত। এজন্য প্রবাদ বাক্য হয়ে রয়েছে, ﻫﻞ ﻣَﺎﺕَ ﺍﻟْﺒُﺨَﺎﺭِﻱُّ ﻏَﻴْﺮَ ﻣَﺤْﺴُﻮْﺩٍ ؟ ‘ইমাম বুখারী কি হিংসুকের হামলা ব্যতীত মৃত্যুবরণ করতে পেরেছেন’? এর পরেও প্রকৃত মুমিনগণ পাল্টা হিংসা করেন না। বিদ্বেষ করেন না। বরং প্রতিপক্ষের হেদায়াত কামনা করেন। কবি কুমায়েত আল-আসাদী বলেন, ﺇﻥ ﻳﺤﺴﺪﻭﻧﻨﻲ ﻓﺈﻧﻲ ﻏﻴﺮُ ﻻﺋﻤﻬﻢ + ﻗﺒﻠﻲ ﻣﻦ ﺍﻟﻨﺎﺱ ﺃﻫﻞُ ﺍﻟﻔﻀﻞ ﻗﺪ ﺣُﺴِﺪُﻭﺍ ﻓﺪﺍﻡ ﻟﻲ ﻭﻟﻬﻢ ﻣﺎ ﺑﻲ ﻭﻣﺎ ﺑﻬﻢ + ﻭﻣﺎﺕ ﺃﻛﺜﺮﻧﺎ ﻏﻴﻈﺎً ﺑﻤﺎ ﻳﺠﺪ ﺃﻧﺎ ﺍﻟﺬﻱ ﻳﺠﺪﻭﻧﻲ ﻓﻲ ﺻﺪﻭﺭﻫﻢ + ﻻ ﺃﺭﺗﻘﻲ ﺻﺪﺭﺍً ﻣﻨﻬﺎ ﻭﻻ ﺃﺭِﺩُ (১) ‘তারা যদি আমাকে হিংসা করে, পাল্টা আমি তাদের নিন্দা করব না। কেননা আমার পূর্বে বহু কল্যাণময় ব্যক্তি হিংসার শিকার হয়েছেন। (২) অতএব আমার ও তাদের সঙ্গে (আল্লাহর রহমত) যা ছিল, তা থাকবে। অথচ আমাদের অধিকাংশ মানুষ মারা গেছে যা সে পেয়েছে তাতে ক্রুদ্ধ অবস্থায়। (৩) আমি সেই ব্যক্তি যে, তারা আমাকে সর্বদা তাদের বুকের মধ্যে পাবে, যেখান থেকে আমি না ফিরে গেছি, না অবতরণ করেছি’। হৃদয়কে হিংসামুক্ত রাখার উপায় : (১) হিংসা হ’ল শয়তানী আমল। শয়তান সর্বদা মানুষকে প্ররোচনা দিয়ে থাকে। তাই তার হাত থেকে বাঁচার জন্য শয়তানের প্রতি তীব্র ঘৃণা থাকা এবং তার বিরুদ্ধে প্রবল ইচ্ছাশক্তি থাকা আবশ্যক। সেইসাথে আল্লাহর আশ্রয় গ্রহণ করে সর্বদা ছালাত শেষে বা ঘুমাতে যাবার সময় বা যেকোন সময় সূরা ফালাক্ব ও নাস পড়া। (২) এছাড়া নিম্নোক্ত দো‘আটি পড়া আবশ্যক। আল্লাহ উম্মতে মুহাম্মাদীকে শিখিয়ে দিয়েছেন, ﺭَﺑَّﻨَﺎ ﺍﻏْﻔِﺮْ ﻟَﻨَﺎ ﻭَﻟِﺈِﺧْﻮَﺍﻧِﻨَﺎ ﺍﻟَّﺬِﻳﻦَ ﺳَﺒَﻘُﻮﻧَﺎ ﺑِﺎﻟْﺈِﻳْﻤَﺎﻥِ ﻭَﻻَ ﺗَﺠْﻌَﻞْ ﻓِﻲْ ﻗُﻠُﻮْﺑِﻨَﺎ ﻏِﻼَّ ﻟِﻠَّﺬِﻳْﻦَ ﺁﻣَﻨُﻮْﺍ ﺭَﺑَّﻨَﺎ ﺇِﻧَّﻚَ ﺭَﺀُﻭْﻑٌ ﺭَﺣِﻴْﻢٌ ‘হে আমাদের প্রতিপালক! আমাদেরকে ও আমাদের সেইসব ভাইকে তুমি ক্ষমা কর। যারা আমাদের পূর্বে ঈমান এনেছে। আর তুমি আমাদের অন্তরে মুমিনদের বিরুদ্ধে কোনরূপ বিদ্বেষ সঞ্চার করো না। হে আমাদের পালনকর্তা! নিশ্চয়ই তুমি স্নেহশীল ও দয়াবান’ (হাশর ৫৯/১০) । মুসলমানকে আল্লাহর পথে সংগ্রামে পরস্পরকে সীসাঢালা প্রাচীরের ন্যায় থাকতে বলা হয়েছে (ছফ ৬১/৪) । এটা কেবল তখনই সম্ভব, যখন হিংসা ও বিদ্বেষমুক্ত মনে আমরা পরস্পরকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসতে পারব এবং এর বিনিয়ে স্রেফ আল্লাহর নিকটে পারিতোষিক কামনা করব। আল্লাহ আমাদের সকলকে পারস্পরিক হিংসা ও বিদ্বেষ থেকে রক্ষা করুন এবং আমাদের সবাইকে ভাই-ভাই হবার তাওফীক দিন- আমীন! [1]. বুখারী হা/৬০৭৬; মুসলিম হা/২৫৫৯; মিশকাত হা/৫০২৮। [2]. বুখারী, মুসলিম; মিশকাত হা/৪৯৬১। [3]. আবুদাঊদ হা/৪৬৮১; তিরমিযী হা/২৫২১; মিশকাত হা/৩০। [4]. ইবনু মাজাহ হা/৪২১৬; মিশকাত হা/৫২২১। [5]. ত্বাবারাণী হা/৮১৫৭; ছহীহাহ হা/৩৩৮৬। [6]. তিরমিযী; মিশকাত হা/৫০৩৯। [7]. হাকেম ৩/৭৯, আহমাদ হা/১২৭২০, আরনাঊত্ব ছহীহ বলেছেন; আলবানী প্রথমে ছহীহ পরে যঈফ বলেছেন (তারাজু‘আতুল আলবানী হা/৪৮); হাকেম ছহীহ বলেছেন এবং যাহাবী তাকে সমর্থন করেছেন। [8]. নাসাঈ হা/৩১০৯, সনদ হাসান। [9]. ইবনু কাছীর, আল-বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহ ৯/২৪৭। [10]. মুসলিম হা/২৫৬৪; মিশকাত হা/৪৯৫৯। [11]. মুসলিম হা/২৫৬৪, মিশকাত হা/৫৩১৪।

Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.