স্বাস্থ্য রক্ষায় শীতের সবজি ও ফলমূল


স্বাস্থ্য রক্ষায় শীতের সবজি ও ফলমূল
আখতারুন নাহার আলো
প্রধান পুষ্টি কর্মকর্তা, বারডেম

শীতকালে কাঁচাবাজার এবং ফলের দোকানে বিভিন্ন রঙ ও আকৃতির সবজি এবং ফলের উপস্থিতি এক নান্দনিক দৃশ্যের সৃষ্টি করে। এসব সবজি ও ফল দিয়ে যেমন খাবারে বৈচিত্র্য আনা যায়, তেমনি এগুলো পুষ্টির দিক দিয়েও কম নয়।
বাঁধাকপি
শীতের অন্যতম প্রধান সবজি। এতে আছে ক্যালসিয়াম, ফলিক এসিড, ভিটামিন সি, ভিটামিন কে ও এ। ভিটামিন ই আছে পর্যাপ্ত পরিমাণে। প্রাচীন রোমানদের কথা থেকে জানা যায়, উৎসবের দিনে অতিরিক্ত মদ্যপানের আগে তারা বাঁধাকপির কচিপাতা চিবিয়ে খেত মাতাল না হওয়ার জন্য। বাঁধাকপি ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ থেকে দেহকে রক্ষা করে এবং শ্বাস-প্রশ্বাসে সাহায্য করে। খনিজ পদার্থের উপস্থিতির জন্য এটি দেহের রক্তে সমতা আনে। মানসিক চাপ, সংক্রমণ, হূৎপিণ্ডের অসুস্থতা ও ক্যান্সার প্রতিরোধে এর ভূমিকা রয়েছে বেশ। এর রঙ সহজে নষ্ট হয় না বলে পুষ্টিগুণের তেমন তারতম্য হয় না। এর ভেতরে মাঝামাঝি জায়গার পাতায় ক্যারোটিন বেশি থাকে। খ্রিস্টপূর্ব চারশতক থেকেই ঔষধি হিসেবে বাঁধাকপি স্বীকৃত।

ফুলকপি

এ সবজিটি বাজার এবং খাওয়ার টেবিলের শ্রীবৃদ্ধি করে। কাঁচা, সিদ্ধ, তরকারি, স্যুপ, নুডলসসহ বিভিন্ন ধরনের নাশতায় এর ব্যবহার হয়। ১০০ গ্রাম ফুলকপিতে আছে ৪১ ক্যালরি, ২.৬ গ্রাম আমিষ, ৭.৫ গ্রাম ভিটামিন সি। এছাড়াও রয়েছে ফসফরাস ও ভিটামিন কে। প্রসবের পর অনেক স্ত্রীলোকের মুখে কালোছোপ পড়তে দেখা যায়। যদি কয়েক দিন নিয়মিতভাবে গাজর, ফুলকপি, বাঁধাকপির জুস খাওয়া যায়, তবে ধীরে ধীরে তা মিলিয়ে যায়।
লাউ
লাউ সহজেই হজম হয় বলে যে কোন রোগের পথ্য হিসেবে অথবা সাধারণ তরকারি হিসেবেও ভালো। দুধলাউ একটি উপাদেয় ও শীতল মিষ্টান্ন। লাউয়ের শাক খুবই পুষ্টিকর। ১০০ গ্রাম লাউয়ে আছে ৬৬ ক্যালরি, ১.১ গ্রাম আমিষ, ১৫.১ গ্রাম শর্করা, ২৬ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম এবং ৮৩.১ গ্রাম জলীয় অংশ। ক্যালরি কম থাকে বলে যাদের ওজন বেশি তারা লাউ বেশি পরিমাণে খেতে পারেন।
টমেটো
শীতের অন্যতম আকর্ষণ টমেটো। এর বর্ণ ও স্বাদ দুটিই ভালো। এটি একটি এন্টিঅক্সিডেন্ট সবজি। এতে লাইকোপিন পর্যাপ্ত পরিমাণে আছে বলে সারাবিশ্বে এটি ক্যান্সাররোধী সবজি হিসেবে স্বীকৃত। টমেটো ত্বক ও চোখের জন্য ভালো। টমেটোতে প্যান্টোথেনিক এসিড আছে বলে পায়ের তলা ও হাতের তালু জ্বালা করার উপসর্গরোধে বেশ সুফল পাওয়া যায়।
শিম
সবজি হিসেবে শিম বেশ উপাদেয়। শিমের বিচিতে প্রচুর আমিষ রয়েছে বলে এর ব্যবহার দেহে আমিষের ঘাটতি মেটাতে পারে। ১০০ গ্রাম শিমে রয়েছে ১.৯ ভাগ আঁশ, ৩৮ ক্যালরি, আমিষ ৩.৯ গ্রাম, শর্করা ৫.৪ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ২৮ মিলিগ্রাম, লৌহ ২.৬ মিলিগ্রাম ও ক্যারোটিন ২ হাজার ৫৪০ মাইক্রোগ্রাম।
গাজর
ক্যারোটিনসমৃদ্ধ সবজি। শিশুর ছয় মাস বয়স থেকে গাজরের রস দিতে পারলে ভালো হয়। এতে ত্বক, চুল ও চোখ ভালো থাকে। শ্বাস-প্রশ্বাসের সংক্রমণ, চোখ ও ত্বকের সংক্রমণে গাজর খুবই উপকারী। কাঁচা গাজর চিবিয়ে খেলে দাঁতে চকচকে ভাব আসে।
মুলা
এতে রয়েছে ফসফরাস, লৌহ, ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স, পটাশিয়াম, ক্যালসিয়াম, সালফার ও ভিটামিন-এ। মুলার রস পিত্তাশয়কে উদ্দীপ্ত করে।
পালং শাক ও লালশাক
পালং শাক লৌহসমৃদ্ধ শাক। এ কারণে রক্তস্বল্পতায় বেশ কার্যকর। এতে অক্সালিক এসিড বেশি আছে বলে এ শাকের ক্যালসিয়াম দেহের কাজে লাগে না। কারণ এটি দেহে শোষিত হয় না। আবার ইউরিক এসিডের আধিক্যের জন্য গাউট, রিউম্যাটিক ফিভার ও কিডনির পাথুরিতে এ শাক বর্জনীয়। লালশাকেও লৌহের পরিমাণ বেশি থাকে। এটি সহজপাচ্য। ১০০ গ্রাম লালশাকে রয়েছে ১.৬ গ্রাম খনিজ পদার্থ, শর্করা ৫.৩ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৩৭৪ মিলিগ্রাম এবং ক্যারোটিন ১১,৯৪০ মাইক্রোগ্রাম।
কমলা
শীতের সময় এ ফল প্রচুর পাওয়া যায়। এটি ভিটামিন সি-সমৃদ্ধ। আয়ুর্বেদিয় চিকিৎসকদের কাছে মধ্যযুগ থেকেই কমলার কদর রয়েছে। কমলা হজম ক্ষমতা বাড়ায় ও এটি স্নায়ু উদ্দীপক। কমলা সর্দি-কাশির উপশম করে। জ্বর ও ইনফ্লুয়েঞ্জার ক্ষেত্রে কমলার রস ভালো কাজ দেয়। দিনে ৩০০ গ্রাম কমলার রস খেলে শরীর তার প্রয়োজনীয় ভিটামিন সি লাভ করে। রক্ত সংবহনতন্ত্রের অসুখ ও হার্টের অসুখেও কমলালেবু উপকারী। কারণ এতে পর্যাপ্ত পটাশিয়াম আছে। কমলা মেগালোব্লাস্টিক এনিমিয়া ও জিভের ঘা থেকে বাঁচায়।
আপেল
রোমান সভ্যতার শুরু থেকেই এ ফলের ব্যবহার হয়ে আসছে। প্রবাদ আছে, দৈনিক একটি আপেল খেলে চিকিৎসকের কাছ থেকে দূরে থাকা যায়। কথাটি মিথ্যা নয়। কারণ আপেলে নিহিত পেকটিন ও ভিটামিন-সি হূদযন্ত্রকে সুস্থ এবং কলেস্টেরলকে নিয়ন্ত্রণে রাখে। পেকটিন আমাদের বায়ু দূষণের হাত থেকেও রক্ষা করে। আপেলে যে ম্যালিক এসিড ও টারটারিক এসিড আছে তা দেহের আবরণকে সংক্রমণ থেকে রক্ষা করে। প্রতিদিন একটি কাঁচা আপেল খেলে বাত ও রিউম্যাটিক থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কোষ্ঠকাঠিন্যেরে ক্ষেত্রে তাজা আপেল খুবই উপকারী। দেখা যায় শীতের সবজিগুলো স্বাদের পাশাপাশি পুষ্টির যোগান দেয়। এজন্য স্বাস্থ্য রক্ষায় এসব শাকসবজি, ফল খাদ্য তালিকায় থাকা প্রয়োজন। শীতকালে রোদের প্রখরতা কম থাকে বলে শাকসবজির ভিটামিন কম নষ্ট হয়।

Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.