রজব মাসের বেদআত : শরিয়তের দৃষ্টিভঙ্গি


রজব মাসের বেদআত : শরিয়তের দৃষ্টিভঙ্গি

রজব মাস পালন, তার ফজিলত, তাতে রোজা রাখা-ইত্যাদি বিষয়ে শরিয়তের দৃষ্টিভঙ্গি যাচাই, এই সময়ের একটি বহুল উচ্চারিত প্রশ্ন। বিষয়টি খুবই তাৎক্ষণিক, তাই আমি এ মাসের সাথে সম্পর্কিত কিছু আহকাম বিষয়ে সংক্ষেপে আলোকপাত করার প্রয়াস পাব, আল্লাহ আমাকে সাহায্য করুন।
রজব : হারাম মাসের একটি
আল্লাহ তাআলা পবিত্র কোরানে এরশাদ করেন-6)
আসমান-জমিনের সৃষ্টি ও সূচনা লগ্ন হতেই আল্লাহর বিধান মতে মাসের নিশ্চিত সংখ্যা বারটি। তার মাঝে চারটি সম্মানিত। এ অমোঘ ও শাশ্বত বিধান ; সুতরাং এর মাঝে তোমরা (অত্যাচার-পাপাচারে লিপ্ত হয়ে) নিজেদের ক্ষতি সাধন করো না। তোমরা সম্মিলিতভাবে মুশরিকদের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হও, যেভাবে তারা সম্মিলিতভাবে তোমাদের সাথে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়। আর জেনে রাখ, আল্লাহ মুত্তাকীদের সাথে আছেন। (তওবা-৩৬)
চার হারাম মাস হচ্ছে-মুহাররম, রজব, জিলকদ ও জিলহজ। আবু বকর রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন, জমানা কাল-চক্রাকারে ঘুরে আসমান-জমিন সৃষ্টির প্রথম দিনের অবস্থায় ফিরে এসেছে। বারো মাসে বৎসর, তার ভেতর চারটি সম্মানিত। তিনটি একসাথে-জিলকদ, জিলহজ, মুহররম। অপরটি-মুদার সম্প্রদায়ের পঞ্জিকা মতে-জুমাদা ও শাবানের মধ্যবর্তী রজব। (বোখারি-মুসলিম)
রজবকে হারাম নামে নামকরণের কারণ
কারণ, তাতে যুদ্ধ-বিগ্রহ নিষিদ্ধ। তবে, শত্রু প্রথমে আক্রমণ করলে প্রতিরোধ করা বৈধ। এ কারণেই তাকে বলা হত বোধির রজব-তাতে হাঁক দেয়া হত না যোদ্ধাদের সমবেত হওয়ার জন্য কিংবা তাতে শোনা যেত না অস্ত্রের ঝনৎকার।
কিংবা তাকে হারাম বলা হয় এ কারণে যে, অন্যান্য মাসের নিষিদ্ধ কর্মের তুলনায় এ মাসের নিষিদ্ধ কর্ম অধিক দূষণীয়। রজব মাসকে রজব বলা হয়, কারণ তা সম্মানিত। الترجيب মানে সম্মান জ্ঞাপন করা। শব্দটি এখান থেকেই উদ্ভূত। (লাতাইফুল মাআরেফ ২২৫)
রজবে প্রবেশের দোয়া
আনাস রা. হতে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন রজব মাসে উপনীত হতেন, তখন এই দোয়া পাঠ করতেন-
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا دخل رجب قال: اللهم بارك لنا في رجب وشعبان، وبلغنا رمضان. وإسناده ضعيف
যখন রজ মাস এসে যেত তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলতেন, হে আল্লাহ আপনি আমাদের রজব ও শাবান মাসে বরকত দান করেন এবং রমজান পর্যন্ত পৌঁছে দেন। ইবনে হাজার ও ইবনে রজব উক্ত হাদিসের সনদ দুর্বল বলে আখ্যায়িত করেছেন।
রজবের দশ তারিখে উপাস্যের উদ্দেশ্যে পশু জবাই
কোন কোন আলেম রজব মাসে পশু জবাই মোস্তাহাব বর্ণনা করেছেন-প্রমাণ হিসেবে তারা উপস্থাপন করেন মাখনাফ বিন সালিম রা:-এর হাদিস। মাখনাফ বিন সালিম রা: বলেন, আমরা রাসূলের সাথে আরাফার মাঠে অবস্থান করছিলাম, আমি শুনলাম তিনি বলেছেন-প্রতিটি বাড়ির অধিকারীদের উপর প্রতি বছর কোরবানি ও রজব মাসের আতীরা কর্তব্য। তোমরা কি অবগত আতীরা কি ? তা হল যাকে তোমরা রজবিয়া বল (অর্থাৎ রজবে জবেহ করার পশু)। আহমদ ৫/৭৬। ইমাম তিরমিজি বলেন-হাদিসটি হাসান ও গরিব। আমরা হাদিসে ইবনে আউনের সূত্র ব্যতীত ভিন্ন কোন সূত্রে হাদিসটি পাই না। মুহাদ্দিস ইবনে হাযম ও আব্দুল হক একে দুর্বল হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। ইবনে কাসীর বলেন-হাদিসটি সনদের ব্যাপারে নানা সংশয় রয়েছে।
অধিকাংশ বিজ্ঞজনের মত এই যে, হাদিসটি মনসূখ (রহিত)। আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল বলেছেন- لا فرع ولا عتيرة অর্থাৎ ইসলামে ফারা আতীরার অস্তিত্ব নেই। (বোখারি ৪৭৪৫)
হাদিসটির ব্যাখ্যায় আবু দাউদ বলেন, কেউ কেউ বলেন-ফারা বলা হয় উটের প্রথম ভূমিষ্ঠ বাচ্চাকে, প্রাচীন আমলে লোকেরা তাদের উপাস্য তাগুতের জন্য একে বলি দিত। অত:পর তার মাংস খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করত, চামড়া ঝুলিয়ে রাখত গাছের ডালে। আতীরা বলা হয় রজবের দশ তারিখে উপাস্যের উদ্দেশ্যে যে পশু বলি দেওয়া হয়, তা। (আস সুনান ৩/১০৪)
ইবনে সীরীন, আবু উবাইদ ও ইসহাক বিন রাহওয়াই প্রমুখ আলেমের মত এই যে, হাদিসটিকে মানসূখ (রহিত) হিসেবে গ্রহণ করাই ওয়াজিব বা আবশ্যক।
রজবে উমরা পালন
মুসলমানদের কোন কোন উপদল রজব মাসকে বিশেষভাবে উমরা পালনের মাস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। তাদের বিশ্বাস এর রয়েছে প্রভূত ফজিলত এবং পরকালীন পুরস্কার। প্রকৃত সত্য ও শুদ্ধ মত হল-রজব অন্যান্য মাসের অবিকল, তার বিশেষত্ব নেই অন্য মাসের তুলনায়। তাতে উমরা পালনের বিশেষ কোন ফজিলত বর্ণনা করা হয় নি। উমরা পালনের ক্ষেত্রে সময় সংশ্লিষ্ট আলাদা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী রমজান মাস এবং হজে তামাত্তুর জন্য হজের মাসগুলো। এ মাসগুলোয় উমরা পালনের বিশেষ ফায়দা হাদিস দ্বারা সাব্যস্ত ও প্রমাণিত। হাদিসের কোথাও এ স্বীকৃতি পাওয়া যায় না যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ মাসে উমরা পালন করেছেন। তাছাড়া, বিষয়টিকে আয়েশা রা: সম্পূর্ণরূপে অস্বীকার করেছেন।
রজব মাসের বেদআত
রজব মাসে মানুষের আবিষ্কৃত এবাদতগুলো নিম্নরূপ –
প্রথমত: সালাতুর রাগায়েব। তা হচ্ছে প্রথম জুমায় বাদ মাগরিব সাতটি সালামের মাধ্যমে বার রাকাত সালাত আদায় করা। প্রতি রাকাতে সূরা ফাতেহা পাঠের পর সূরা কদর তিনবার পাঠ করবে এবং সূরা ইখলাস পাঠ করবে বার বার। সালাত হতে ফারেগ হবার পর সত্তুর বার দরুদ পাঠ করবে, এরপর দোয়া করবে ইচ্ছামত। সন্দেহ নেই এবাদতের এ প্রক্রিয়া সম্পূর্ণরূপে বেদআত, বর্জনীয়। এ সম্পর্কিত হাদিসটি সন্দেহাতীতভাবে মাওজু। ইবনে জাওজি তার এক রচনায় ইমাম নববির বরাতে উল্লেখ করেন যে, আলেমগন এর মাধ্যমে সালাতের কারাহাত প্রমাণ করেছেন আল্লাহ তাআলা এর উদ্ভাবক ও উদ্‌পাদককে ধ্বংস করুন। এ নিশ্চয় বেদআত, সুতরাং, সর্বার্থে বর্জনীয়। তা নিশ্চয় পথভ্রষ্টতা, মূর্খতা-তাতে পালন করা এমন কিছু, যা বর্জনীয়। আলেমদের একটি বৃহৎ শ্রেণি একে ভ্রান্ত প্রমাণ করে নানা গ্রন্থ সংকলন করেছেন, এ সালাত আদায়কারীকে পথভ্রষ্ট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন
খাত্তাবী রহ: বলেন, সালাতুর রাগায়েব সংক্রান্ত হাদিসটি মিথ্যার অপলাপ বৈ নয়। হাফেজ ইবনে রজব রহ: বলেন-রজব মাসের সাথে বিশিষ্ট কোন সালাত নেই। সালাতুর রাগায়েবের ফজিলত সংক্রান্ত যাবতীয় হাদিস মিথ্যা, ভ্রান্তিপ্রসূত-যা কোন ভাবেই শুদ্ধ হতে পারে না। অধিকাংশ আলেমের সক্রিয় রায় অনুসারে এ সালাত বেদআত। হিজরি চার শতকের পরে এ সালাতের অস্তিত্ব ইতিহাসে পাওয়া যায়, তাই আমরা দেখতে পাই, প্রথম যুগের আলেমগণ এ ব্যাপারে কিছুই উল্লেখ করেননি।
দ্বিতীয়ত: মধ্য রজবের সালাত। এ সংক্রান্ত যাবতীয় হাদিস মওজু।
তৃতীয়ত: মেরাজের রাত্রির সালাত। তা রজবের সাতাশ তারিখে আদায় করা হয়। একে বলা হয় লাইলাতুল মেরাজের সালাত। এ এমন বেদআতী সালাত, যার কোন শরয়ি ভিত্তি নেই। রজব মাসেই মেরাজ সংগঠিত হয়েছে-এ দাবিরও কোন জোড়ালো ভিত্তি পাওয়া যায় না। আবু শামাহ রহ: বলেন, কিছু কিছু গল্পকার বলেছেন যে, রজব মাসেই মেরাজ সংগঠিত হয়েছে। সঠিক পথের অনুসারীদের কাছে এ নিশ্চিত বিভ্রান্তি, মিথ্যা-প্রসূত।
পক্ষান্তরে আবু ইসহাক উল্লেখ করেন যে, রবিউল আউয়ালের সাতাশ তারিখে রাসূলের মেরাজ সংগঠিত হয়। যারা এ হাদিসের মাধ্যমে দলিল প্রদান করে সালাত আদায় করেন যে, রাসূল বলেছেন-রজব মাসে এমন এক রাত্রি রয়েছে, যে রাতের আমলকারিকে একশো বছরের পুণ্য প্রদান করা হয়। তা হচ্ছে রজবের সাতাশ তারিখ। হাফেজ ইবনে হাজার, ইমাম বায়হাকী প্রমুখ আলেম একে দুর্বল হাদিস হিসেবে বর্ণনা করেছেন।
উক্ত রাত্রির আরো বেদআত এই যে, সম্মিলিত ভাবে উদযাপন, মূমূর্ষ ব্যক্তিদের জেয়ারত, খাদ্যোৎসব-ইত্যাদি। শায়েখ আলী ক্বারী বলেন-সন্দেহ নেই, এ খুবই মন্দ বেদআত, গর্হিত কর্ম-কারণ, তাতে অকারণে সম্পদের অপচয় করা হয়, পৌত্তলিকদের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ আচরণ করা হয়।
রজবের রোজা
রজব মাসে রোজা পালনের ব্যাপারে স্বতন্ত্র কোন ফজিলত বর্ণনা করা হয় নি। বরং অন্যান্য মাসের মতই তাতে এবাদত করা হবে, রোজা রাখা হবে- যেভাবে রাখা হয় অন্যান্য মাসে। পেশাদার ওয়ায়েজ ও গল্পকার ভণ্ড ধার্মিকরা এর ফজিলত বর্ণনা প্রসঙ্গে যে হাদিস বর্ণনা করেন যে-রাসূল বলেছেন-
রজবে রয়েছে একটি নহর, যার পানি বরফের তুলনায় সফেদ-শুভ্র, মধুর তুলনায় মিষ্ট, রজব মাসে যে একটি রোজা রাখবে, সে তা হতে পান করবে।
উক্ত হাদিসটি সর্বৈবে বাতিল অগ্রহণযোগ্য। অন্য একটি হাদিস, যা বর্ণিত হয়েছে এভাবে-
অর্থ : রজব এক মহৎ ও মহান মাস। আল্লাহ তাতে পুণ্য দ্বিগুণ করে দেন। যে রজবের এক দিন রোজা রাখবে সে যেন পুরো বছরই রোজা পালন করল। আর যে সাত দিন রোজা রাখবে তার জন্য জাহান্নামের সাতটি দরজা বন্ধ করে দেয়া হবে। আর ব্যক্তি পনেরো দিন রোজা পালন করবে, আকাশের একজন ঘোষক তাকে ডেকে বলবে-তোমার ইতিপূর্বের সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দেয়া হয়েছে, সুতরাং নতুনরূপে আমলের সূচনা কর। আর যে এরও অধিক করবে, আল্লাহ তাকে আরো অধিক পুরস্কারে ভূষিত করবেন- একে ইবনে হাজার আসকালানী বাতিল বলে সাব্যস্ত করেছেন।
আমি নিবন্ধটির সমাপ্তি করছি হাফেজ ইবনে কায়্যিম ও ইবনে হাজার রহ: মন্তব্য দ্বারা, ইবনে কায়্যিম বলেন-রজবের রোজা ও সালাতের ব্যাপারে যে হাদিসগুলো উল্লেখ করা হয়, তার সবই মিথ্যা, অগ্রহণযোগ্য, সুতরাং বর্জনীয়। পক্ষান্তরে ইবনে হাজারের মন্তব্য ছিল-রজব মাসের ফজিলত, তাতে রোজা পালন, কিংবা নির্দিষ্ট কোন অংশে ও রাতে রোজা ও সালাত আদায়-ইত্যাদি বিষয়ে প্রামাণ্য কোন শুদ্ধ হাদিস পাওয়া যায় না, যার মাধ্যমে বিষয়টি প্রামাণ্যতার মানদণ্ডে উন্নীত হবে। আমরা আল্লাহর তওফিক কামনা করি।

লেখক : কাউসার বিন খালিদ
সম্পাদনা : আব্দুল্লাহ শহীদ আব্দুর রহমান
সূত্র : ইসলাম প্রচার ব্যুরো, রাবওয়াহ, রিয়াদ

ওয়েব গ্রন্থনা : আবুল কালাম আযাদ আনোয়ার /সার্বিক যত্ন : আবহাছ এডুকেশনাল এন্ড রিসার্চ সোসাইটি, বাংলাদেশ।

Leave a comment

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.